চর্যাপদ বিস্তারিত - নতুনদের জন্য বাংলা সাহিত্যের প্রস্তুতি।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ: ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই সময়কালটি প্রায় ৬৫০ বছর বিস্তৃত, যার একমাত্র নির্ভরযোগ্য এবং প্রামাণ্য নিদর্শন হলো চর্যাপদ। এই যুগকে অনেকে অন্ধকার যুগ হিসেবেও চিহ্নিত করেন, কারণ চর্যাপদের পর থেকে মধ্যযুগের শুরু পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় না। তবে চর্যাপদই প্রমাণ করে যে বাংলা ভাষার একটি নিজস্ব সাহিত্যিক রূপ এই সময়কালেই বিকশিত হয়েছিল।
চর্যাপদ: আবিষ্কারের কাহিনী
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে যখন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে (নেপাল রয়াল লাইব্রেরি) একটি পুথির সন্ধানে যান। সেখানে তিনি একাধিক প্রাচীন পুথির মাঝে একটি তালপাতার পুথি খুঁজে পান, যা ছিল গানের সংকলন। তিনি এই পুথিটির নামকরণ করেন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। এটিই আমাদের চর্যাপদ। দীর্ঘ ৯ বছর গবেষণার পর ১৯১৬ সালে তিনি এই পুথিটি 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে চর্যাপদ ছাড়াও আরও দুটি পুথি (ডাকার্ণব ও সরহপা এবং কৃষ্ণবজ্রপাদের দোহা) প্রকাশিত হয়েছিল।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অনুসন্ধান ও নেপাল যাত্রা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর অনুসন্ধানী মন এবং ঐতিহাসিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে বুঝেছিলেন যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন পুঁথিগুলো বাংলায় না থাকলেও অন্য কোনো স্থানে থাকতে পারে। এর মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন।
- বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন: সেন আমলে, বিশেষ করে লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে, বাংলায় বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়। হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা কমে যাওয়ায় অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু, পণ্ডিত এবং সাধক পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
- নেপালের নিরাপত্তা: নেপাল ছিল একটি বৌদ্ধপ্রধান রাজ্য এবং এর রাজকীয় গ্রন্থাগারগুলো ধর্মীয় পুঁথিপত্রের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। এই কারণে বহু বৌদ্ধ পণ্ডিত তাদের মূল্যবান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে নেপালে চলে যান।
- অনুমিত অনুসন্ধান: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাংলা থেকে পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ পণ্ডিতরা তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পুঁথিগুলো নিয়ে গেছেন। তাঁর অনুমান ছিল, যেহেতু নেপাল ভৌগোলিকভাবে বাংলার নিকটবর্তী এবং সেখানে বৌদ্ধধর্মের প্রচলন ছিল, তাই সেখানেই এই ধরনের পুঁথিগুলো পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে তিনি ১৯০৭ সালে নেপালে যান এবং নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে (Royal Library of Nepal) প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালান। সেখানেই তিনি তিনটি পুঁথি পান, যার মধ্যে একটি ছিল 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। এটিই পরবর্তীতে চর্যাপদ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর এই অনুসন্ধানে কেবল একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনই আবিষ্কৃত হয়নি, বরং বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপও প্রমাণিত হয়েছে। এই আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দূরদর্শিতার প্রমাণ দেয়।
চর্যাপদ কেন নেপালে পাওয়া গেল: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
চর্যাপদের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা সাহিত্যকর্ম কেন নেপালে পাওয়া গেল, এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কারণ।
- ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা: চর্যাপদ মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের দ্বারা রচিত। সেন বংশের শাসনামলে (১১-১২ শতক) বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়। হিন্দু রাজা বল্লাল সেন এবং তার উত্তরসূরি লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব ছিল। এই কারণে বহু বৌদ্ধ সাধক, পণ্ডিত ও ভিক্ষু তাদের ধর্মগ্রন্থ ও পুঁথিপত্র নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
- ভৌগোলিক নৈকট্য: নেপাল ভৌগোলিকভাবে বাংলার নিকটবর্তী একটি দেশ। তাই ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এটি ছিল বৌদ্ধদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তারা তাদের মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থগুলো সেখানে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করেন।
- সংরক্ষণ: নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারগুলোতে বহু প্রাচীন পুঁথি ও পান্ডুলিপি সুরক্ষিত অবস্থায় ছিল। এই কারণে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যখন ১৯০৭ সালে সেখানে অনুসন্ধান চালান, তখন তিনি চর্যাপদসহ আরও অনেক প্রাচীন পুঁথি খুঁজে পান।
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই প্রমাণ করে যে শুধুমাত্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে নিজ ভূমি ছেড়ে যাওয়া বৌদ্ধ সাধকদের হাতেই চর্যাপদের মতো মূল্যবান গ্রন্থ নেপালে পৌঁছায় এবং সেখানে সংরক্ষিত হয়।
চর্যাপদের প্রধান বৈশিষ্ট্য
চর্যাপদ শুধু একটি প্রাচীন সাহিত্যকর্ম নয়, এটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক অনন্য দলিল। এর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো:
- সন্ধ্যা ভাষা: এটি চর্যাপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই ভাষার অর্থ 'আঁধারি' বা রহস্যময়, যেখানে একটি আপাত অর্থ থাকে এবং তার আড়ালে গভীর ধর্মীয় ও দার্শনিক অর্থ লুকিয়ে থাকে। যেমন, একটি পদে নৌকা চালানোর বর্ণনা থাকলেও এর ভেতরের অর্থ হলো সাধন প্রক্রিয়ার রূপক।
- মাত্রাবৃত্ত ছন্দ: চর্যাপদের প্রতিটি পদ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এর প্রতিটি পদের শেষে 'ধ্রুবপদ' বা ধুয়া থাকে, যা গানের সুর ও লয়কে নির্দেশ করে।
- ধর্মীয় সাধনতত্ত্ব: চর্যাপদের মূল বিষয়বস্তু হলো বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধন পদ্ধতি, আচার-আচরণ এবং দার্শনিক তত্ত্ব।
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র: চর্যাপদে তৎকালীন সমাজের বহু চিত্র ফুটে উঠেছে। যেমন: ডোমের জীবন, শবরদের জীবনযাত্রা, নৌকা চালনা, শিকার, বিবাহ, এবং বিভিন্ন ধরনের পেশার বর্ণনা। এটি তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।
গুরুত্বপূর্ণ পদকর্তা ও তাঁদের পরিচিতি
চর্যাপদের মোট পদকর্তা ছিলেন ২৪ জন, যাদেরকে সিদ্ধাচার্য বলা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন পদকর্তা তাদের পদের সংখ্যা এবং সাহিত্যিক গুরুত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
লুইপা
লুইপা চর্যাপদের আদি বা প্রথম পদকর্তা হিসেবে পরিচিত। তাঁর রচিত পদের সংখ্যা ২টি।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ১ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "কায়া তরুবর পঞ্চ বি ডাল"
- ব্যাখ্যা: এই পদের মাধ্যমে লুইপা মানবদেহকে একটি গাছের সাথে তুলনা করেছেন, যার পাঁচটি ডাল বা শাখা হলো আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক)। এটি সাধনতত্ত্বের একটি রূপক ব্যাখ্যা। এই পদের মূল অর্থ হলো—দেহ এক বৃক্ষস্বরূপ, আর এই বৃক্ষের পাঁচটি ডালকে সামলে নিয়ে সাধন পথে এগিয়ে যেতে হয়।
কাহ্নপা
কাহ্নপা চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেছেন, মোট ১৩টি। তাঁর পদগুলোতে রূপক ও গভীর দার্শনিক তত্ত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ১০ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "নগর বাহিরি ডোম্হি তোহোরি কুড়িয়া"
- ব্যাখ্যা: এই পদে কাহ্নপা তৎকালীন সমাজের বর্ণপ্রথা এবং অবহেলিত ডোম সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। 'ডোম্হি' এখানে সাধন পথের গুরুত্বপূর্ণ সহচরী হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। এটি শুধু একটি সমাজচিত্র নয়, বরং সাধন পথের রূপক বর্ণনাও বটে।
ভুসুকুপা
ভুসুকুপা ছিলেন একজন খ্যাতিমান পদকর্তা, যিনি মোট ৮টি পদ রচনা করেছেন। তাঁর পদগুলোতে গভীর ভাব ও রূপকের ব্যবহার লক্ষণীয়।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ২৬ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী"
- ব্যাখ্যা: এই পদের মাধ্যমে ভুসুকুপা একজন সাধকের নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। 'টাল' বা টিলার উপর তার ঘর, যার কোনো প্রতিবেশী নেই—এটি একাকী সাধন ও আত্ম-অনুসন্ধানের প্রতীক। এই পদে সংসার থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে সাধনা করার কথা বলা হয়েছে।
শবরপা
শবরপা মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক এবং তার পদগুলোতে শবর জাতির জীবনচিত্রের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ৫০ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "উঁচু উঁচু পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী"
- ব্যাখ্যা: এই পদে শবরপা শবর জাতির জীবনচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে 'পাবত' (পাহাড়) এবং 'সবরী বালী' (শবরী বালিকা) প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শবরী বালিকা এখানে সাধন পথের এক গুরুত্বপূর্ণ যোগিনী, যিনি সাধন যাত্রার সঙ্গী। এটি চর্যাপদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ যা থেকে তৎকালীন জাতিগত পরিচয় এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
কুক্কুরীপা
কুক্কুরীপা চর্যাপদের একজন গুরুত্বপূর্ণ পদকর্তা। তার রচিত পদের সংখ্যা ২টি। তিনি নারী চরিত্রের রূপক ব্যবহার করে পদ রচনা করেছেন।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ২ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "দুয়ি ঘরে বহিঅ দুয়ি সাঝা"
- ব্যাখ্যা: এই পদে কুক্কুরীপা বলেছেন, 'দুটি ঘরে দু'বেলা সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা আছে'। এই লাইনটি দ্বারা সাধকের মনের দুটি দিক বোঝানো হয়েছে: এক, প্রজ্ঞা বা জ্ঞান এবং দুই, কৌশল বা উপায়। এই দু'টি উপায়ের সমন্বয়ে সাধন পথে এগিয়ে যেতে হয়।
শান্তিপা
শান্তিপা চর্যাপদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধাচার্য। তিনি মোট ২টি পদ রচনা করেছেন।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ১৫ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "সোনা ভনই রূঅ রুচি লোহা"
- ব্যাখ্যা: এই পদে শান্তিপা বলেছেন, 'সোনার মতো সুন্দর রূপ, লোহার মতো রুক্ষ নয়'। এখানে সোনা ও রূপা হলো রূপক। এই পদটির মাধ্যমে সাধকের কঠিন এবং জটিল সাধন পথকে সরলীকরণ করে বোঝানো হয়েছে।
ঢেণ্ঢণপা
ঢেণ্ঢণপা রচিত পদের সংখ্যা ১টি। তাঁর রচিত পদটি তৎকালীন সামাজিক চিত্র তুলে ধরেছে।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ৩৩ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী"
- ব্যাখ্যা: এই পদে ঢেণ্ঢণপা একাকী সাধকের মনের অবস্থার বর্ণনা করেছেন। 'টিলার উপরে আমার বাড়ি, কোনো প্রতিবেশী নেই'—এই লাইনটি সাধকের নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা এবং একাগ্র সাধনার প্রতীকী রূপ। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে সাধন পথে কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না, বরং একাগ্রচিত্ততাই আসল শক্তি।
কম্বলাম্বরপা
কম্বলাম্বরপা চর্যাপদের একজন পদকর্তা। তার রচিত পদের সংখ্যা ১টি।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ৮ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "বসনতন্তি লাহল উবালি"
- ব্যাখ্যা: এই পদের মাধ্যমে কম্বলাম্বরপা মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। 'কাপড়ের তাঁত ও লোহার মতো'—এই লাইনটি দিয়ে জীবনের বস্তুগত দিকগুলোর সাথে আধ্যাত্মিক সাধনার সমন্বয় বোঝানো হয়েছে।
সারহপা
সারহপা বা সরহপা চর্যাপদের অন্যতম প্রধান সিদ্ধাচার্য। তিনি মোট ৪টি পদ রচনা করেছেন, যার মধ্যে ১টি পদ পাওয়া গেছে। তিনি বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ছিলেন।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ৩২ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "কঙ্গু ণি কুণ্ডিঅ পসা"
- ব্যাখ্যা: এই পদে সারহপা বলেছেন, 'হাতে কড় এবং কানে কুণ্ডল ধারণ করো'। এটি বৌদ্ধ সাধকদের ধর্মীয় পোশাক ও রূপকের একটি বর্ণনা। এই পদের মাধ্যমে সাধকের বাহ্যিক আচার-আচরণের চেয়েও অন্তরের সাধনা যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝানো হয়েছে।
বিরূপা
বিরূপা একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। তার রচিত পদের সংখ্যা ২টি। তার পদগুলোতে বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির গভীর রূপক বর্ণনা রয়েছে।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ৪২ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "নিতি নিতি সিয়াল সিয়ে"
- ব্যাখ্যা: এই পদের মাধ্যমে বিরূপা বলেছেন, 'নিত্য নিত্য শৃগাল শিকার করে'। এখানে 'শৃগাল' প্রতীকী অর্থে অজ্ঞতা, লোভ এবং অহংকারের মতো রিপু বা অশুভ শক্তিকে বোঝানো হয়েছে। এই পদটির মাধ্যমে সাধককে এসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করার কথা বলা হয়েছে।
ভাদেপা
ভাদেপা একজন গুরুত্বপূর্ণ পদকর্তা, যিনি মাত্র ১টি পদ রচনা করেছেন। তার পদে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দৈনন্দিন জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।
- গুরুত্বপূর্ণ পদ: ১৪ নম্বর পদ।
- পদের প্রথম লাইন: "আলি কালি মেলিলি তালি"
- ব্যাখ্যা: এই পদে ভাদেপা বলেছেন, 'লোহা ও কয়লা মিশিয়ে বিক্রি করো'। এখানে 'লোহা' এবং 'কয়লা' জীবনের কঠোর বাস্তবতা এবং জীবিকা নির্বাহের প্রতীকী রূপ। এই পদের মাধ্যমে সাধন পথের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার কথাও বলা হয়েছে।
চর্যাপদের ভাষা ও সাহিত্যিক গুরুত্ব
চর্যাপদের ভাষা সন্ধ্যা ভাষা বা সান্ধ্য ভাষা নামে পরিচিত। এই ভাষার অর্থ অনেকটা রহস্যময় বা আলো-আঁধারি। বাইরের দিকে একটি সাধারণ অর্থ এবং ভেতরের দিকে একটি গভীর দার্শনিক ও ধর্মীয় অর্থ থাকে। এই কারণে এই ভাষাটিকে সহজে বোঝা যায় না। চর্যাপদের ভাষা নিয়ে বাংলা, অসমীয়া, উড়িয়া, মৈথিলী এবং নেপালী ভাষার পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও, ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে এর মূল ভিত্তি বাংলা।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য: ৫০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্ন - উত্তর।
- চর্যাপদের সাথে কোন ধর্মীয় মতবাদ জড়িত? (ক) শাক্ত (খ) শৈব (গ) সহজিয়া বৌদ্ধ (ঘ) বৈষ্ণব
- চর্যাপদের কোন পদটি সম্পূর্ণ পাওয়া যায়নি? (ক) ২৩ নম্বর (খ) ২৪ নম্বর (গ) ২৫ নম্বর (ঘ) ২৬ নম্বর
- কে চর্যাপদের আধুনিক রূপান্তর করেন? (ক) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (খ) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (গ) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (ঘ) সুকুমার সেন
- চর্যাপদে উল্লিখিত রাগ কতটি? (ক) ৩০টি (খ) ৩২টি (গ) ৩৫টি (ঘ) ৩৮টি
- চর্যাপদের পদকর্তাদের কী নামে ডাকা হয়? (ক) গুরু (খ) ঋষি (গ) আচার্য (ঘ) সিদ্ধাচার্য
- 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা' গ্রন্থটি কোথা থেকে প্রকাশিত হয়? (ক) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (খ) এশিয়াটিক সোসাইটি (গ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (ঘ) নেপাল রাজকীয় গ্রন্থাগার
- চর্যাপদের পুঁথিটি কোন রাজবংশের আমলে রচিত? (ক) সেন (খ) পাল (গ) গুপ্ত (ঘ) চন্দ্র
- চর্যাপদের কোন পদের প্রথম লাইন "কায়া তরুবর পঞ্চ বি ডাল"? (ক) ১ নম্বর (খ) ২ নম্বর (গ) ৩ নম্বর (ঘ) ১০ নম্বর
- কোন পদকর্তা চর্যাপদের প্রথম পদটি রচনা করেন? (ক) কাহ্নপা (খ) লুইপা (গ) ভুসুকুপা (ঘ) শবরপা
- চর্যাপদের ভাষা কোন ভাষা হিসেবে পরিচিত? (ক) প্রাকৃত ভাষা (খ) সন্ধ্যা ভাষা (গ) অপভ্রংশ ভাষা (ঘ) বাংলা ভাষা
- চর্যাপদের প্রাপ্ত পদের সংখ্যা কত? (ক) ৪৬টি (খ) ৪৬.৫টি (গ) ৪৭টি (ঘ) ৪৮টি
- চর্যাপদের পুঁথির পাতাগুলো কী দিয়ে তৈরি ছিল? (ক) কাগজ (খ) তালপাতা (গ) গাছের ছাল (ঘ) শ্লেট
- চর্যাপদের ভাষা নিয়ে বাংলা, অসমীয়া ও কোন ভাষার পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে? (ক) হিন্দি (খ) উড়িয়া (গ) মারাঠি (ঘ) মৈথিলী
- চর্যাপদের পদকর্তাদের মধ্যে কে রাজা ছিলেন? (ক) কাহ্নপা (খ) লুইপা (গ) বিরূপা (ঘ) ভুসুকুপা
- চর্যাপদের ধর্মীয় সাধনতত্ত্বে 'নৌকা' কিসের প্রতীক? (ক) জীবন (খ) সংসার (গ) দেহ (ঘ) মন
- চর্যাপদের কোন পদটিতে 'মৎস্য' শিকারের কথা বলা হয়েছে? (ক) ৩০ নম্বর (খ) ৩৩ নম্বর (গ) ৩৬ নম্বর (ঘ) ৩৯ নম্বর
- চর্যাপদের কোন পদটিতে 'শবরদের' জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে? (ক) ৪২ নম্বর (খ) ৫০ নম্বর (গ) ৪৮ নম্বর (ঘ) ৪৯ নম্বর
- চর্যাপদের ভাষা কে 'আঁধারি' ভাষা বলেছেন? (ক) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (খ) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (গ) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (ঘ) সুকুমার সেন
- চর্যাপদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী? (ক) ধর্মতত্ত্ব (খ) ইতিহাস (গ) লোককথা (ঘ) বিজ্ঞান
- চর্যাপদের পদগুলোতে ব্যবহৃত 'ডোম্হি' শব্দটি কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? (ক) সাধারণ নারী (খ) নিম্নবর্ণের নারী (গ) যোগিনী (ঘ) স্ত্রী
- 'টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী' – এই পদটির মাধ্যমে কী বোঝানো হয়েছে? (ক) গ্রাম্য জীবন (খ) নির্জন সাধন (গ) সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (ঘ) প্রকৃতির ভালোবাসা
- চর্যাপদ কোন ছন্দে রচিত? (ক) অক্ষরবৃত্ত (খ) স্বরবৃত্ত (গ) মাত্রাবৃত্ত (ঘ) অমিত্রাক্ষর
- চর্যাপদ একটি— (ক) মহাকাব্য (খ) গীতিকাব্য (গ) আখ্যান কাব্য (ঘ) কাহিনিকাব্য
- চর্যাপদে উল্লিখিত রাগ কতটি? (ক) ৩০টি (খ) ৩২টি (গ) ৩৩টি (ঘ) ৩৬টি
- চর্যাপদের টীকাটি কোন ভাষায় রচিত? (ক) পালি (খ) সংস্কৃত (গ) বাংলা (ঘ) মৈথিলী
- চর্যাপদের প্রথম পদটি কে রচনা করেন? (ক) লুইপা (খ) কাহ্নপা (গ) ভুসুকুপা (ঘ) শবরপা
- 'নদী' কিসের প্রতীক? (ক) জীবন (খ) সংসার (গ) দেহ (ঘ) মন
- চর্যাপদের কোন পদটি নারীর রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে? (ক) শবরের পদ (খ) ডোমের পদ (গ) লুইপার পদ (ঘ) ভুসুকুপার পদ
- চর্যাপদে কতজন নারীর উল্লেখ আছে? (ক) ৩ জন (খ) ৪ জন (গ) ৫ জন (ঘ) ৬ জন
- চর্যাপদ কোন যুগের সাহিত্য? (ক) প্রাচীন (খ) মধ্য (গ) আধুনিক (ঘ) কোনটিই নয়
- চর্যাপদের পুঁথিটি যে রাজকীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল, সেটির অবস্থান কোথায়? (ক) কাঠমান্ডু (খ) দিল্লী (গ) ললিতপুর (ঘ) ত্রিভুবন
- চর্যাপদের পদসংখ্যা মোট কয়টি? (ক) ৪৯টি (খ) ৪৭টি (গ) ৫০টি (ঘ) ৫২টি
- চর্যাপদের রচনার মূল উদ্দেশ্য কী? (ক) ধর্মপ্রচার (খ) সাহিত্য রচনা (গ) সাধনতত্ত্বের ব্যাখ্যা (ঘ) সমাজ সংস্কার
- চর্যাপদ কোন পরিষদে প্রকাশিত হয়? (ক) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (খ) এশিয়াটিক সোসাইটি (গ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঘ) বাংলা একাডেমি
- 'বসনতন্তি লাহল উবালি' পদটি কার রচনা? (ক) লুইপা (খ) কম্বলাম্বরপা (গ) কাহ্নপা (ঘ) কুক্কুরীপা
- চর্যাপদের পদগুলো কোন ছন্দে রচিত? (ক) অক্ষরবৃত্ত (খ) স্বরবৃত্ত (গ) মাত্রাবৃত্ত (ঘ) মুক্তক
- চর্যাপদের ধর্মীয় সাধনতত্ত্বে 'শিকার' কিসের প্রতীক? (ক) জ্ঞানার্জন (খ) ইন্দ্রিয় দমন (গ) ধর্মপ্রচার (ঘ) সমাজসেবা
- চর্যাপদের ভাষা কোন ভাষাগুলোর সাথে সম্পর্কিত? (ক) বাংলা, অসমীয়া (খ) উড়িয়া, মৈথিলী (গ) হিন্দি, গুজরাটি (ঘ) সবকয়টি
- চর্যাপদের টীকাটি কোন ভাষার মিশ্রণ? (ক) সংস্কৃত ও বাংলা (খ) পালি ও বাংলা (গ) সংস্কৃত ও প্রাকৃত (ঘ) পালি ও প্রাকৃত
- চর্যাপদের কোন পদটি আংশিক পাওয়া যায়? (ক) ২৫ (খ) ৩৩ (গ) ৩৪ (ঘ) ৩৫
- চর্যাপদকে 'অন্ধকার যুগের' সাহিত্য হিসেবে কে চিহ্নিত করেছেন? (ক) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (খ) সুকুমার সেন (গ) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (ঘ) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
- চর্যাপদের পদগুলোতে ব্যবহৃত 'ডোম্হি' শব্দটি কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? (ক) সাধারণ নারী (খ) নিম্নবর্ণের নারী (গ) যোগিনী (ঘ) স্ত্রী
- চর্যাপদের পদকর্তাদের মধ্যে 'রাজা' কে ছিলেন? (ক) কাহ্নপা (খ) লুইপা (গ) কুক্কুরীপা (ঘ) ভুসুকুপা
- চর্যাপদের কোন পদে 'পোশাক' সম্পর্কে বর্ণনা আছে? (ক) ৮ নম্বর (খ) ৯ নম্বর (গ) ১০ নম্বর (ঘ) ১১ নম্বর
- চর্যাপদের কোন পদটি নারীর প্রতীক? (ক) ডোম্হি (খ) শবরি (গ) যোগিনী (ঘ) সবগুলিই
- চর্যাপদের কোন পদটিতে 'হরিণ' শিকারের কথা বলা হয়েছে? (ক) ১ নম্বর (খ) ২ নম্বর (গ) ৩ নম্বর (ঘ) ৫ নম্বর
- চর্যাপদের প্রাপ্ত মোট পদসংখ্যা কত? (ক) ৪৬.৫ (খ) ৪৭ (গ) ৪৮ (ঘ) ৪৯
- চর্যাপদের টীকাটি কে রচনা করেন? (ক) কাহ্নপা (খ) লুইপা (গ) মুনিদত্ত (ঘ) শান্তিদেব
- চর্যাপদের প্রধান সুর কী? (ক) দর্শন (খ) ইতিহাস (গ) প্রেম (ঘ) প্রকৃতি
- চর্যাপদ কত বছরের পুরোনো? (ক) এক হাজার বছর (খ) দুই হাজার বছর (গ) ৫০০ বছর (ঘ) ৪০০ বছর
উত্তরমালা
- গ 2. গ 3. ক 4. খ 5. ঘ 6. ক 7. খ 8. ক 9. খ 10. খ 11. খ 12. খ 13. খ 14. ঘ 15. গ 16. খ 17. ঘ 18. গ 19. ক 20. গ 21. খ 22. গ 23. খ 24. খ 25. খ 26. ক 27. খ 28. খ 29. খ 30. ক 31. ক 32. গ 33. গ 34. ক 35. খ 36. গ 37. খ 38. ঘ 39. ক 40. গ 41. খ 42. গ 43. ঘ 44. ক 45. ঘ 46. গ 47. ক 48. গ 49. ক 50. ক
আজকের এই আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, চর্যাপদ কেবল একটি প্রাচীন গ্রন্থ নয়, বরং এটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল ভিত্তি। এর প্রতিটি পদেই লুকানো আছে এক গভীর দর্শন, যা আজও আমাদের গবেষণার বিষয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্য ও আধুনিক যুগের সাহিত্য নিয়ে এমন আরও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য জানতে এবং নিজেদের পরীক্ষার প্রস্তুতিকে আরও সুদৃঢ় করতে আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত অনুসরণ করা অপরিহার্য। এখানে আপনি পাবেন বিসিএস প্রস্তুতি, পিএসসি পরীক্ষা, শিক্ষক নিবন্ধন এবং ব্যাংক নিয়োগ-এর মতো সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য। আমরা প্রতিটি বিষয়ের উপর গভীরভাবে গবেষণা করে পরীক্ষামুখী প্রশ্নোত্তর তৈরি করি, যা আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে। তাই বাংলা সাহিত্যের সকল গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং অন্যান্য বিষয়ের নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করুন।
আরো দেখুন ----
১.Verb কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি – বিস্তারিত ব্যাখ্যা, নিয়ম ও উদাহরণ MCQ প্রশ্ন সহ।