৯ম-১০ম শ্রেণির বাংলা: উপেক্ষিত শক্তির উদ্‌বোধন—কেন এই 'ছোটোলোক'ই জাতির আসল শক্তি? (সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ ও সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর)

 

"উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন" –  সহজ ভাষায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ।

এই শিরোনামটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে গঠিত: . উপেক্ষিত শক্তি এবং . উদ্বোধন

. উপেক্ষিত শক্তি

নবম দশম শ্রেণী। উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন। বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা।

"উপেক্ষিত শক্তি" বলতে কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের সেই বিরাট ক্ষমতা সম্ভাবনাকে বুঝিয়েছেন, যা থাকা সত্ত্বেও দেশের বৃহত্তর জনগণ দ্বারা ব্যবহৃত হয় না বা ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলিত হয়।

  • শক্তি কাদের মধ্যে: এই শক্তি মূলত দেশের তথাকথিত 'ছোটোলোক' বা নিম্নবর্গের মানুষদের (যেমনকৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুর, চণ্ডাল ইত্যাদি) মধ্যে সুপ্ত আছে। প্রবন্ধের ভাষায়, এরা দেশের "দশ আনা শক্তি" বহন করে।

  • কেন উপেক্ষিত: এই শক্তি উপেক্ষিত, কারণ সমাজের আভিজাত্য-গর্বিত ভদ্র সম্প্রদায় বংশ, অর্থ সামাজিক মর্যাদার অহংকারে এদের ঘৃণা করে, অবহেলা করে এবং নানাভাবে অত্যাচার করে। এই অবহেলা অত্যাচারে তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায় এবং তাদের ভেতরের ক্ষমতা প্রকাশিত হতে পারে না।

  • শক্তির স্বরূপ: এই শক্তি শুধুমাত্র শারীরিক শ্রম নয়, বরং তাদের সরল মন, আন্তরিকতা, উদারতা এবং প্রতিকূলতা সহ্য করার বিপুল ক্ষমতা নজরুল এই শক্তিকে "বিরাট বিপুল শক্তি-সিংহ সুপ্ত" বলে অভিহিত করেছেন।

. উদ্বোধন

"উদ্বোধন" শব্দের অর্থ হলো জাগ্রত করা, ঘুম ভাঙানো বা শুরু করা ।

  • কাকে উদ্বোধন: এখানে উদ্বোধন বলতে সেই সুপ্ত 'ছোটোলোক' সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।

  • কীভাবে উদ্বোধন: এই জাগরণ বা উদ্বোধন হবে কোনো আদেশ বা অত্যাচারের মাধ্যমে নয়, বরং ভালোবাসা, সম্মান, সহানুভূতি এবং সমানাধিকারের মাধ্যমে। মহাত্মা গান্ধির উদাহরণ টেনে নজরুল দেখিয়েছেন, তাদের পাশে গিয়ে তাদের মতো জীবনযাপন করে, ভাই বলে বুকে টেনে নিয়ে এই শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে।

 

সারসংক্ষেপ: "উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন" মানে হলোযে জনশক্তিকে আমরা বংশ বা টাকার জোরে অবহেলা করে ফেলে রেখেছি, সেই সুপ্ত সিংহ-শক্তির ঘুম ভাঙানোর মাধ্যমে দেশ জাতিকে নতুন এক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করা।

 

উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন: বিস্তারিত ব্যাখ্যা, বাস্তব উদাহরণ শিক্ষণীয় বিষয়।

এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের তথাকথিত 'ছোটোলোক' বা নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি সম্মান ভালোবাসা জাগিয়ে তুলে তাদের মাধ্যমে দেশের জাগরণ ঘটানো।

 

শিক্ষার্থির জন্য মূল তথ্য

শিক্ষার্থীদের বোঝার জন্য এই প্রবন্ধের মূল ধারণা কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:

মূল ধারণা

ব্যাখ্যা

উপেক্ষিত শক্তি

দেশের সেই বৃহৎ জনসমষ্টি, যারা সমাজের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে (যেমন: কৃষক, শ্রমিক, মজুর), অথচ যাদেরকে উচ্চশ্রেণির মানুষ অবহেলা করে। এঁরাই জাতির উন্নতির প্রধান চালিকাশক্তি।

আভিজাত্য-গর্বিত সম্প্রদায়

সমাজের সেই ধনী, উচ্চ বংশের অহংকারী লোকেরা, যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অন্যদের ঘৃণা করে।

দশ আনা শক্তি

মোট শক্তির অধিকাংশ বা বেশিরভাগ অংশ (অর্থ: সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ)

মসিময় অন্ধকার

কালির মতো কালো এবং অন্ধকারযা এখানে অহংকার, মিথ্যাচার ভণ্ডামিতে ভরা মন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

খোদার উপর খোদকারি

ঈশ্বরের কাজের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব ফলানো। এখানে এর অর্থ হলোঈশ্বর মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন, অথচ মানুষ নিজের তৈরি নিয়ম দিয়ে একজনকে ছোটো একজনকে বড় করার চেষ্টা করছে।

জনশক্তি বা গণতন্ত্র

জনগণের শক্তি বা জনগণের শাসন। নজরুল মনে করেন, উপেক্ষিতদের বাদ দিয়ে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।

বোধন-বাঁশি

বোধ জাগিয়ে তোলার বাঁশি। অর্থাৎ, নতুন করে সচেতনতা বা জাগরণ সৃষ্টি করা।

 

উপেক্ষিত শক্তির উদ্‌বোধন: মূল প্রবন্ধের  বিস্তারিত ।

মূল প্রবন্ধের অংশ (কাজী নজরুল ইসলাম)

বিস্তারিত ব্যাখ্যা, উদাহরণ  (শিক্ষার্থীর জন্য)

১. ভূমিকা ও উপেক্ষিত শক্তির পরিচয়

১. উপেক্ষিত শক্তিই আসল ভিত্তি  

হে মোর দুর্ভাগা দেশ! যাদের করেছ অপমান অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। -রবীন্দ্রনাথ

উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু: নজরুল রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি দিয়ে প্রবন্ধ শুরু করে বলছেন, যাদের আমরা অপমান করি, সেই অপমানের ফল আমাদেরই ভোগ করতে হবে। 

আজ আমাদের এই নূতন করিয়া মহাজাগরণের দিনে আমাদের সেই শক্তিকে ভুলিলে চলিবে না – যাহাদের উপর আমাদের দশ আনা শক্তি নির্ভর করিতেছে, অথচ আমরা তাহাদিগকে উপেক্ষা করিয়া আসিতেছি। সে হইতেছে, আমাদের দেশের তথাকথিত ‘ছোটোলোক’ সম্প্রদায়।

দেশের মূল শক্তি: দেশের জাগরণের জন্য সেই অধিকাংশ (দশ আনা) শক্তিকে জাগাতে হবে, যারা উপেক্ষিত। এঁরাই হলেন সমাজের শ্রমজীবী ও নিম্নবর্গের মানুষ। 

শিক্ষণীয় বিষয়: জাতীয় শক্তি বা জনশক্তি বলতে সমাজের উচ্চশ্রেণি নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষকেই বুঝতে হবে।

আমাদের আভিজাত্য-গর্বিত সম্প্রদায়ই এই হতভাগাদের এইরূপ নামকরণ করিয়াছেন। কিন্তু কোনো যন্ত্র দিয়া এই দুই শ্রেণির লোকের অন্তর যদি দেখিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে, ওই তথাকথিত ‘ছোটোলোক’-এর অন্তর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ, এবং ওই আভিজাত্যগর্বিত তোমাদের ‘ভদ্রলোকের’ অন্তর মসিময় অন্ধকার

মনের পার্থক্য: আভিজাত্যের অহংকারীরাই 'ছোটোলোক' নাম দিয়েছে। কিন্তু এদের মন সরল ও পরিষ্কার (কাচের মতো)। আর 'ভদ্রলোকদের' মন অহংকার ও ভণ্ডামিতে ভরা (মসিময় অন্ধকার)। 

বাস্তব উদাহরণ: একজন কৃষক সরল মনে পরিশ্রম করে, কিন্তু একজন স্বার্থপর ধনী ব্যক্তি লোকদেখানো কাজ করে। কবির চোখে কৃষকই বেশি সৎ।

২. অধঃপতনের কারণ ও ভদ্র সমাজের ব্যর্থতা

২. অত্যাচারের ফল ও ভদ্র সমাজের অক্ষমতা 

এই ‘ছোটোলোক’ এমন স্বচ্ছ অন্তর... লইয়াও যে কোনো কার্য করিতে পারিতেছে না, তাহার কারণ এই ভদ্র সম্প্রদায়ের অত্যাচার। সে-বেচারা জন্ম হইতে এই ঘৃণা, উপেক্ষা পাইয়া নিজেকে এত ছোটো মনে করে, সংকোচ জড়তা তাহার স্বভাবের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়াইয়া যায়...

অত্যাচারের ফল: এই সরল মানুষগুলো কাজ করতে পারে না, কারণ ভদ্রলোকদের অত্যাচার ও ঘৃণার ফলে তাদের মনে সংকোচ, জড়তা ও হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।  

অত্যাচারই তাদের কর্মবিমুখতার মূল কারণ।

...সেও যে সেই এক আল্লাহ্-এর সৃষ্টি, তাহারও যে মানুষ হইবার সমান অধিকার আছে, – তাহা সে একেবারে ভুলিয়া যায়। যদি কেউ এই উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করে, অমনই আমাদের ভদ্র সম্প্রদায় তাহার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলে

অধিকার ভুল ও দমন: তারা মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার ভুলে যায়। কেউ প্রতিবাদ করলেই উচ্চশ্রেণি তাকে নির্মমভাবে দমন করে। 

বাস্তব উদাহরণ: সমাজে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবিকে মালিকপক্ষ বা প্রভাবশালীরা সহজে পাত্তা না দিয়ে বা দমন করে দেয়।

এই হতভাগাদিগকে... অবহেলা করিয়া চলিয়াছি বলিয়াই আজ আমাদের এত অধঃপতন; তাই আমাদের দেশে জনশক্তি বা গণতন্ত্র গঠিত হইতে পারিতেছে না। ... তাহার উন্নতির আশা করা আর আকাশে অট্টালিকা নির্মাণের চেষ্টা করা একই কথা

জাতীয় ক্ষতি: এই সত্যিকার মানুষদের অবহেলা করার ফলেই দেশ দুর্বল (অধঃপতন) হচ্ছে এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। 

শিক্ষণীয় বিষয়: জনগণকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নতি আশা করা পুরোপুরি অবাস্তব (আকাশে অট্টালিকা নির্মাণের মতো)।

তোমাদের এই আভিজাত্যগর্বিত, ভণ্ড, মিথ্যুক, ভদ্র সম্প্রদায় দ্বারা... মনে কর কী দেশ-উদ্ধার হইবে...? তোমরা ভদ্র সম্প্রদায়... দুর্ভাগ্যের কথা কহিয়া কাঁদাইতে পার, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নামিয়া কার্য করিবার শক্তি তোমাদের আছে কি? না, নাই।

ভদ্রলোকের অক্ষমতা: অহংকারী ও ভণ্ড ভদ্রলোকরা কেবল বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে কাঁদতে শেখায়, কিন্তু বাস্তবে দেশের জন্য কাজ করার ক্ষমতা তাদের নেই। 

শিক্ষণীয় বিষয়: দেশপ্রেম বা সমাজসেবা কেবল কথায় নয়, ত্যাগ ও কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়।

৩. জাগরণের সমাধান ও মহাত্মা গান্ধির উদাহরণ

৩. সমাধানের পথ: ভালোবাসা ও গান্ধিজীর মন্ত্র 

কিন্তু যদি একবার আমাদের এই জনশক্তিকে উদ্‌বুদ্ধ করিতে পার, তাহাদিগকেও মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার তোমার উদারতা থাকে... তাহা হইলে দেখিবে তুমি শত বৎসর ধরিয়া প্রাণপণে চেষ্টা সত্ত্বেও যে-কাজ করিতে পারিতেছ না, একদিনে সেই কাজ সম্পন্ন হইবে

সমাধান: যদি আমরা এই মানুষকে ভাই বলে বুকে টেনে নিতে পারি, তবে অসম্ভব কাজও খুব সহজে সম্ভব হবে। 

শিক্ষণীয় বিষয়: আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্মানই এই জনশক্তিকে জাগানোর একমাত্র উপায়।

একথা হয়তো তোমার বিশ্বাস হইবে না, কিন্তু এই সেদিনকার সত্যাগ্রহ, হরতালের কথা মনে কর দেখি, – একবার মহাত্মা গান্ধির কথা ভাবিয়া দেখো দেখি! তিনি আজ ভারতে কী অসাধ্য সাধন করিতে পারিয়াছেন।

উদাহরণ: মহাত্মা গান্ধী: লেখক প্রমাণ হিসেবে মহাত্মা গান্ধীকে দেখিয়েছেন।

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯ – ১৯৪৮) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা ও অহিংস 'সত্যাগ্রহ' আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে ভারতে অসহযোগ ও ডান্ডি লবণ কুচকাওয়াজ-এর মতো অহিংস সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও স্বাধীনতার অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন এবং 'জাতির জনক''মহাত্মা' নামে পরিচিত ছিলেন।


তিনি যদি এমনই করিয়া প্রাণ খুলিয়া ইহাদের সহিত না মিশিতেন... ইহাদিগকে যদি নিজের বুকের রক্ত দিয়া, তাহারা খাইতে পাইল না বলিয়া নিজেও তাহাদের সঙ্গে উপবাস করিয়া ইহাদিগকে নিতান্ত আপনার করিয়া না তুলিতেন...

গান্ধীর মন্ত্র: গান্ধীজি তাঁর আভিজাত্য ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের কষ্টে নিজেও কষ্ট ভোগ করেছেন (উপবাস)। এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েই তিনি তাদের আপন করে তুলেছিলেন। 

বাস্তব উদাহরণ: কোনো নেতা যখন শীতকালে সাধারণ মানুষের মতো কম্বল ছাড়াই ফুটপাতে রাত কাটান, তখন তাদের প্রতি সাধারণের বিশ্বাস ও সমর্থন জন্মায়।

তাঁহার আভিজাত্য-গৌরব নাই... অনায়াসে প্রাণের মুক্ত উদারতা লইয়া তোমাদের ঘৃণ্য এই ‘ছোটোলোক’-কে বক্ষে ধরিয়া ভাই বলিয়া ডাকিয়াছেন... তাই নিখিল ভারতবাসী, এই উপেক্ষিত হতভাগারা তাঁহার দিকে এত হাহা করিয়া ব্যগ্রবাহু মেলিয়া ছুটিয়াছে।

স্নেহের ফল: তাঁর আন্তরিক আহ্বান শুনেই সমস্ত ভারতবাসী, বিশেষ করে উপেক্ষিতরা, তাঁর দিকে ছুটে গিয়েছিল। 

শিক্ষণীয় বিষয়: সত্যিকার ডাক বা আহ্বান জাতি, ধর্ম ও সমাজ মানে না।

৪. আত্মার অবমাননা ও হুঁশিয়ারি

৪. মানুষকে ঘৃণা করা ঈশ্বরের অপমান ।

ইহাদিগকে উপেক্ষা করিবার, মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার তোমার কী অধিকার আছে? ইহা তো আত্মার ধর্ম নয়। তাহার আত্মা তোমার আত্মার মতোই ভাস্বর, এর একই মহা-আত্মার অংশ।

অধিকারের প্রশ্ন: মানুষকে ঘৃণা করার অধিকার কারও নেই, কারণ সবাই একই পবিত্র আত্মার অংশ। এটা মানবতার বা আত্মার ধর্ম নয়।

শিক্ষণীয় বিষয়: সকল মানুষের প্রতি সম্মান দেখানো নৈতিক ও মানবিক কর্তব্য।

এই আত্মার অপমানে, যে সেই অনাদি অনন্ত মহা-আত্মারই অপমান করা হয়... খোদার সৃষ্ট... এই মানুষকে ঘৃণা করিবার অধিকার তোমায় কে দিয়াছে?... এসব যে তোমারই নিজের সৃষ্টি, – খোদার উপর খোদকারি

ঈশ্বরের অপমান: মানুষকে ঘৃণা করা মানে স্রষ্টা বা মহা-আত্মাকে অপমান করা। নিজের তৈরি নিয়ম দিয়ে একজনকে বড় বা ছোটো ভাবা হলো খোদার উপর কর্তৃত্ব দেখানো—যা এক গুরুতর পাপ।

মরিতে তো বসিয়াছ, – যদি এখনও এই মৃত হতভাগ্যদের হাত ধরিয়া না উঠিয়া একা উঠিতে যাও, তবে আরও মার খাইয়া মরিবে। কীসের পতিত ইহারা? ইহাদের প্রাণ যত উন্মুক্ত – ইহাদের অন্তর যেমন সরল... সে প্রাণে বিরাট বিপুল শক্তি-সিংহ সুপ্ত হইয়া রহিয়াছে, – যদি পার সেই শক্তিকে জাগাও।

শেষ সতর্কবার্তা: এই উপেক্ষিতদের বাদ দিয়ে একা উন্নতি করার চেষ্টা করলে আরও বেশি আঘাত পেতে হবে। এদের ভেতরে বিরাট সুপ্ত শক্তি (শক্তি-সিংহ) ঘুমিয়ে আছে। 

শিক্ষণীয় বিষয়: বাইরের দিক থেকে গরিব হলেও, তাদের মনের শক্তি অনেক বড়।

৫. শেষ আহ্বান

৫. মুক্তির পথ: একাত্মতা ও সংকল্প ।

আমাদের এই পতিত, চণ্ডাল, ছোটোলোক ভাইদের বুকে করিয়া তাহাদিগকে আপন করিয়া লইতে, তাহাদেরই মতো দীন বসন পরিয়া, তাহাদের প্রাণে তোমারও প্রাণ সংযোগ করিয়া উচ্চশিরে ভারতের বুকে আসিয়া দাঁড়াও, দেখিবে বিশ্ব তোমাকে নমস্কার করিবে।

একাত্মতা: এই ভাইদের আপন করে নিতে হবে, তাদের মতো সাধারণের পোশাক (দীন বসন) পরতে হবে এবং তাদের সঙ্গে মন থেকে মিশতে হবে। 

শিক্ষণীয় বিষয়: যখন দেশের সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে, তখনই ভারত মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং বিশ্ব তাকে সম্মান জানাবে।

এসো, আমাদের উপেক্ষিত ভাইদের হাত ধরিয়া আজ ভারত-বেদির সামনে দাঁড়াইয়া বোধন-বাঁশিতে সুর দিই – ‘কীসে দুঃখ, কীসের দৈন্য, কীসের লজ্জা, কীসের ক্লেশ!’

সঙ্কল্প: এই উপেক্ষিত শক্তিকে নিয়ে আমরা শপথ নিই, যাতে এই দেশে আর কোনো দুঃখ, দারিদ্র্য বা লজ্জা না থাকে। 

শিক্ষণীয় বিষয়:  এই ঐক্যবদ্ধ শক্তির জাগরণই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।

 

উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন: বাস্তব উদাহরণসহ ব্যাখ্যা

কাজী নজরুল ইসলামের এই প্রবন্ধে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি বৈষম্য তার জাতীয় ক্ষতি তুলে ধরেছেন।

. মনের পার্থক্য শক্তির উৎস

মূল বক্তব্য

বাস্তব উদাহরণ

'ছোটোলোক'-এর অন্তর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ বনাম 'ভদ্রলোক'-এর অন্তর মসিময় অন্ধকার

একজন কৃষক বা রিকশাচালক তার কষ্টার্জিত আয়ের বেশিরভাগটাই সরল মনে পরিবারের জন্য খরচ করে। অন্যদিকে, একজন দুর্নীতিপরায়ণ বিত্তবান ব্যক্তি তার বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা কথা ভণ্ডামি করে সাধারণের কাছ থেকে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়। নজরুলের চোখে, কৃষকই আন্তরিকতার কারণে প্রকৃত 'ভদ্রলোক'

এই ছোটোলোক’-এর দশ আনা শক্তি অবহেলায় পড়ে আছে।

একটি দেশের পোশাক শিল্পে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই শ্রমিকরা সামান্য মজুরি মানবিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের শ্রমই দেশের দশ আনা শক্তি, যা উপেক্ষিত।

 

. অবহেলা জনশক্তির ক্ষতি

মূল বক্তব্য

বাস্তব উদাহরণ

ভদ্র সম্প্রদায়ের অত্যাচার ঘৃণার ফলে 'ছোটোলোক'রা সংকোচ জড়তা পেয়ে নিজেদের ছোটো মনে করে।

কোনো অফিসে একজন নিচুতলার কর্মচারী (পিয়ন বা ক্লিনার) যদি তার কাজে দক্ষতা বা কোনো নতুন সমস্যা সমাধানের বুদ্ধি দেয়, তবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়শই তার সামাজিক অবস্থানের কারণে সেই বুদ্ধি তুচ্ছ করে এড়িয়ে যান। ফলে কর্মচারীটি ভবিষ্যতে আর উৎসাহ দেখায় না।

এই অবহেলায় দেশে জনশক্তি বা গণতন্ত্র গঠিত হচ্ছে না।

একটি অঞ্চলে বন্যা বা মহামারী দেখা দিলে, নেতারা কেবল জনসভায় বক্তৃতা দেন বিদেশ থেকে সাহায্য আনেন। কিন্তু নিচে নেমে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক, কৃষক বা জেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন না। জনগণের এই একতাকে কাজে না লাগালে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক জাগরণ আসে না।

 

. মুক্তির উপায়: ভালোবাসার উদ্বোধন

মূল বক্তব্য

বাস্তব উদাহরণ

মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার উদারতা থাকলে একদিনে অসাধ্য সাধন সম্ভব।

একটি এলাকায় যখন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি হয়, তখন স্থানীয় প্রভাবশালী উচ্চবংশের কোনো নেতা যদি তার আভিজাত্য ত্যাগ করে সব পক্ষের মানুষের কাছে যান এবং তাদের বুকে টেনে নিয়ে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন, তবে সেই নেতার প্রতি মানুষের বিশ্বাস জাগে। এই বিশ্বাসই অসাধ্য শান্তি স্থাপন করতে পারে।

মহাত্মা গান্ধির দৃষ্টান্ত: তিনি দীন বসন পরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে উপবাস করতেন।

গান্ধীজি যখন বিদেশি কাপড় বর্জন করে নিজেই চরকা কেটে সুতো বুনতেন এবং সাধারণ ধুতি-চাদর পরতেন, তখন দেশের কৃষক, তাঁতি, মজুররা তাঁকে নিজেদের একজন মনে করত। তাঁর এই একাত্মতাই কোটি কোটি মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করতে পেরেছিল।

 

. মানবিক আহ্বান সতর্কতা

মূল বক্তব্য

বাস্তব উদাহরণ

মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার তোমার কী অধিকার আছে? ইহা তো খোদার উপর খোদকারি

একটি বিদ্যালয়ে যদি শিক্ষকের সন্তান বা ধনী ব্যবসায়ীর সন্তান মেধার ভিত্তিতে নয়, কেবল সামাজিক পরিচয়ের কারণে বেশি গুরুত্ব পায়, তবে এটি মানবতা ঈশ্বরের সাম্য নীতির ঘোর বিরোধী। এখানে শিক্ষক নিজের তৈরি নিয়ম দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে ভেদাভেদ করছেন।

দীন বসন পরিয়া, তাহাদের প্রাণে তোমারও প্রাণ সংযোগ করিয়া উচ্চশিরে ভারতের বুকে আসিয়া দাঁড়াও।

আজ আধুনিক যুগে, কোনো ব্যবসায়ী বা সমাজকর্মী যদি কেবল নিজের লাভ না দেখে, বরং শ্রমিক বা গ্রামীণ মহিলাদের সাথে মাটিতে বসে তাদের সমস্যা শোনেন এবং তাদের উন্নতির জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেন, তবে সেই কাজ সমাজকে দ্রুত বদলে দেয়। এই একাত্মতাই দেশ জাতিকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

 

প্রবন্ধের মূল বক্তব্য

"উপেক্ষিত শক্তির উদ্‌বোধন" প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের তথাকথিত 'ছোটোলোক' বা নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি সমাজের 'ভদ্র''আভিজাত্য-গর্বিত' সম্প্রদায়ের চরম উপেক্ষা ও অত্যাচারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এই উপেক্ষিত মানুষেরাই দেশের দশ আনা শক্তি বহন করে, কিন্তু তাদের অবহেলা করার কারণেই দেশের অধঃপতন হয়েছে এবং জনশক্তি বা গণতন্ত্র গঠিত হতে পারছে না।

মূল বিষয়বস্তুগুলি হলো:

১. উপেক্ষিত শক্তির গুরুত্ব: দেশের বেশিরভাগ শক্তি তথাকথিত 'ছোটোলোক' সম্প্রদায়ের হাতে, কিন্তু আভিজাত্য-গর্বিত সম্প্রদায় তাদের উপেক্ষা করে আসছে।

২. মানসিকতার পার্থক্য: 'ছোটোলোক'-এর অন্তর কাচের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু 'ভদ্রলোক'-এর অন্তর মসিময় অন্ধকারে পূর্ণ। 

৩. অধঃপতনের কারণ: ভদ্র সম্প্রদায়ের অত্যাচার, ঘৃণা ও উপেক্ষার ফলে এই সরল মানুষেরা নিজেদের ছোটো মনে করে, তাদের সংকোচ ও জড়তা গ্রাস করে এবং তারা কোনো কাজ করতে পারে না। তাদের অবহেলা করার ফলেই দেশের অধঃপতন হয়েছে। 

৪. ভদ্রলোকের অক্ষমতা: ভদ্র সম্প্রদায় দেশের দুর্দশা নিয়ে কথা বলতে পারলেও, কার্যক্ষেত্রে নেমে কাজ করার শক্তি তাদের নেই। তাদের দ্বারা দেশ বা জাতির সত্যিকার উন্নতি সম্ভব নয়। 

৫. জনশক্তিকে জাগানোর আহ্বান: লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, যদি একবার এই জনশক্তিকে ভাই বলে বুকে টেনে নিয়ে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগানো যায়, তবে শত বছরের অসাধ্য কাজও একদিনে সম্পন্ন হবে। 

৬. মহাত্মা গান্ধির উদাহরণ: মহাত্মা গান্ধি কীভাবে আভিজাত্যের অহংকার ত্যাগ করে দরিদ্র মানুষের সাথে মিশে, তাদের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে, নিজের বুকের রক্ত দিয়ে আপন করে তুলে সারা ভারতে এক মহাজাগরণ সৃষ্টি করেছেন, লেখক সেই উদাহরণ দিয়েছেন। 

৭. মানবিক অধিকার ও আত্মার ধর্ম: মানুষকে ঘৃণা করার অধিকার কারও নেই, কারণ সবাই একই খোদার সৃষ্টি এবং একই মহা-আত্মার অংশ। এই ঘৃণা আত্মার অবমাননা, যা মহা-অপরাধ এবং জাতীয় অধঃপতনের কারণ। 

৮. সমাধান: লেখক আহ্বান জানিয়েছেন, সবাইকে দীন বসন পরে, উপেক্ষিত ভাইদের হাত ধরে, তাদের বুকে টেনে নিয়ে উচ্চশিরে ভারতের বুকে দাঁড়াতে। তবেই বিশ্ব তাদের নমস্কার করবে এবং দেশে যুগান্তর আসবে।

কঠিন শব্দের অর্থ 

আপনার অনুরোধ অনুসারে, প্রদত্ত শব্দার্থের তালিকা থেকে বন্ধনীতে থাকা ইংরেজি শব্দগুলো বাদ দিয়ে নিচে উপস্থাপন করা হলো:


প্রবন্ধের শব্দ ও অর্থ (ইংরেজি শব্দ বাদ দিয়ে)

শব্দঅর্থ
উপেক্ষাঅবহেলা, অগ্রাহ্য করা, মনোযোগ না দেওয়া।
আভিজাত্য-গর্বিতবংশমর্যাদা বা কৌলীন্যের অহংকারী।
তথাকথিতযা এভাবে পরিচিত বা কথিত, কিন্তু বাস্তবে নাও হতে পারে।
মসিময়কালিমাময়, কালো রংযুক্ত (এখানে অন্ধকার বা কলুষতার অর্থে ব্যবহৃত)।
ওতপ্রোতভাবেনিবিড়ভাবে, ঘনিষ্ঠভাবে।
বিদ্রোহাচরণবিদ্রোহ করা, বিরুদ্ধাচরণ করা।
অধঃপতনঅবনতি, পতন।
সমষ্টিযোগফল, একত্রীকরণ।
অট্টালিকাপ্রাসাদ, ইমারত।
নিরেটখাঁটি, সম্পূর্ণ (এখানে 'খাঁটি সত্য' অর্থে ব্যবহৃত)।
উদ্‌বুদ্ধজাগ্রত, সজাগ, জেগে উঠেছে এমন।
উন্মেষবিকাশ, স্ফুরণ, প্রকাশ।
সত্যাগ্রহসত্যের প্রতি অবিচল থেকে অহিংস উপায়ে আন্দোলন করা (এখানে মহাত্মা গান্ধির আন্দোলন বোঝানো হয়েছে)।
নিখীল ভারতবাসীসমগ্র ভারতের অধিবাসী।
ভাস্বরদীপ্তিমান, উজ্জ্বল।
চণ্ডালহিন্দু বর্ণব্যবস্থায় নিম্নবর্গের লোক।
অনাদি অনন্তযার শুরু বা শেষ নেই (পরমাত্মা বা আল্লাহকে বোঝানো হয়েছে)।
খোদকারিঅতিরিক্ত কর্তৃত্ব, খোদার কাজে হস্তক্ষেপ।
দীন বসনদরিদ্রের পোশাক, সাধারণ পোশাক।
বোধন-বাঁশিবোধ জাগিয়ে তোলার বাঁশি।
দৈন্যদারিদ্র্য, দীনতা।

কাজী নজরুল ইসলামের পরিচিতি

পরিচিতির ক্ষেত্র

বিস্তারিত তথ্য

নাম

কাজী নজরুল ইসলাম

জন্ম

১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সাল (২৪শে মে ১৮৯৯)

জন্মস্থান

চুরুলিয়া গ্রাম, আসানসোল মহকুমা, বর্ধমান জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

উপাধি

'বিদ্রোহী কবি' (সামাজিক অবিচার পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে)

সাহিত্য-জীবনের সূচনা

ছেলেবেলায় লেটো গানের দলে যোগ দেন। ১৯১৭ সালে বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচিতে থাকাকালীন সাহিত্য-জীবনের শুরু।

সাহিত্যিক অবদান

কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, গজল, খেয়াল রাগপ্রধান গান রচনা। বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন এবং কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার।

গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম

কাব্যগ্রন্থ: অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল

গল্প উপন্যাস: ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা

প্রবন্ধগ্রন্থ: যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রাজবন্দীর জবানবন্দী

শেষ জীবন অসুস্থতা

মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারান।

সম্মান মর্যাদা

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে আনা হয়, নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়।

মৃত্যু

২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সাল।

মৃত্যুস্থান সমাধি

ঢাকার পি.জি. হাসপাতাল (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত।

সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর: উপেক্ষিত শক্তির উদ্‌বোধন

উদ্দীপক

মফস্বলের যুবক সবুজ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও শহরের অভিজাত সমাজে কোনো সম্মান পেল না। বরং তার গ্রামের বাড়ি, দরিদ্র কৃষক বাবা ও অনাড়ম্বর জীবন নিয়ে সে সর্বত্র অপমানিত হলো। একদিন সে শহরের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে গ্রামে ফিরে এলো। সেখানে সে দেখল, কৃষকরা ঋণের দায়ে জর্জরিত, কিন্তু তাদের মাঝে অপার শক্তি ও সাহস লুকানো আছে। সবুজ তার বাবার মতোই সাধারণ লুঙ্গি-শার্ট পরে কৃষকদের সাথে মাঠে নামল, তাদের হাতে হাত রাখল এবং তাদের সমস্যার সমাধানে পাশে দাঁড়াল। কয়েক মাসের মধ্যেই সেই কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্থানীয় মহাজনদের অত্যাচার রুখে দিল এবং সমবায়ের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাল।

 

প্রশ্নমালা 

ক) নজরুলের মতে, তথাকথিত 'ছোটোলোক'-এর অন্তর কেমন?

খ) "অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান" – উক্তিটির অর্থ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা করো। 

গ) উদ্দীপকের সবুজের গ্রামের দিকে ফিরে আসা এবং কৃষকদের জাগিয়ে তোলার মধ্যে "উপেক্ষিত শক্তির উদ্‌বোধন" প্রবন্ধের কোন দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে? ব্যাখ্যা করো।

ঘ) "যদি পার, এমনি করিয়া ডাকো, এমনি করিয়া এই উপেক্ষিত শক্তির বোধন করো – দেখিবে ইহারাই দেশে যুগান্তর আনিবে, অসাধ্য সাধন করিবে।" – উদ্দীপক ও প্রবন্ধের আলোকে উক্তিটির যথার্থতা বিশ্লেষণ করো।

 

উত্তরমালা

) জ্ঞানমূলক প্রশ্ন

নজরুলের মতে, তথাকথিত 'ছোটোলোক'-এর অন্তর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ, সরল উদার

 

) অনুধাবনমূলক প্রশ্ন

রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিটির অর্থ হলো, সমাজের আভিজাত্যগর্বিত সম্প্রদায় যদি বৃহত্তর জনশক্তিকে (তথাকথিত 'ছোটোলোক') ঘৃণা অপমান করে পিছিয়ে রাখে, তবে একসময় সেই অপমানকারী জাতি হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়বে

এই দুর্বলতা বা 'অধঃপতন'-এর ফলস্বরূপ, একসময় ভদ্র সমাজও তাদের অবহেলিত অংশের সমপর্যায়ের হয়ে যাবে। অর্থাৎ, দেশের একাংশকে দুর্বল করে রেখে সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়অপমানকারী অপমানিত উভয়েই একই শোচনীয় পরিণতি ভোগ করে সমান হবে।

 

) প্রয়োগমূলক প্রশ্ন

উদ্দীপকের সবুজের গ্রামের দিকে ফিরে আসা এবং কৃষকদের জাগিয়ে তোলার মধ্যে প্রবন্ধের আভিজাত্য ত্যাগ করে জনশক্তির সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং তাদের সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে।

সবুজ শহরে অপমানিত হয়ে তার শিক্ষিত হওয়ার অহংকার ত্যাগ করে সাধারণ পোশাকে (দীন বসন) কৃষকদের পাশে মাঠে নামে। সবুজের এই একাত্মতা নজরুলের সেই আহ্বানের সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে তিনি 'ভাই বলিয়া কোল' দেওয়ার কথা বলেছেন।

সবুজের আন্তরিকতা কৃষকদের মধ্যে লুকানো বিরাট বিপুল শক্তি জাগিয়ে তোলে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহাজনদের অত্যাচার রুখে দেয়, যা তাদের 'উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন'-কে প্রমাণ করে।

 

) উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা প্রশ্ন

প্রবন্ধ উদ্দীপকের আলোকে উক্তিটি সম্পূর্ণরূপে যথার্থ এই উক্তিটি জাতীয় মুক্তি জাগরণের মূলমন্ত্র।

প্রথমত, নজরুল দেখিয়েছেন যে ভণ্ড ভদ্রলোকের কথার ফুলঝুরি দ্বারা দেশ উদ্ধার সম্ভব নয়, কারণ তাদের কার্য করিবার শক্তি নেই একমাত্র দেশের সরল শক্তিশালী উপেক্ষিত জনগণের দ্বারাই কঠিন কাজ সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, মহাত্মা গান্ধী তাঁর আভিজাত্য ত্যাগ করে এবং সাধারণের সঙ্গে মিশে স্নেহ ভালোবাসার 'বোধন-বাঁশি' বাজিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, কোটি কোটি মানুষ একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার 'অসাধ্য সাধন' করেছিল।

তৃতীয়ত, উদ্দীপকেও সবুজ যখন আন্তরিকভাবে কৃষকদের পাশে দাঁড়ায়, তখন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহাজনদের অত্যাচার রুখে দেয় এবং নিজেদের অবস্থার উন্নতি করে। এই সংগঠিত পরিবর্তনটিই হলো সেই 'যুগান্তর'

সুতরাং, ঘৃণা বৈষম্য দূর করে জনশক্তিকে হৃদয় দিয়ে আহ্বান করতে পারলেই তাদের মধ্যে সুপ্ত ক্ষমতা জাগ্রত হবে, যা দেশকে অবশ্যই অসাধ্য সাধন এবং 'যুগান্তর' এনে দেবে।

 আরো দেখুন

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'প্রত্যুপকার' গল্পের বিস্তারিত

 সৃজনশীল সমাধান সহ (৯ম-১০ম শ্রেণি)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন